ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন হাফেজ রফিকুল ইসলাম। ওই কাজে যৎসামান্য যা আয় হতো তা দিয়েই কোনোরকমে ঘুরত তার সংসারের চাকা। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ডাকে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশে গিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। একটি গুলিতে হারান পা। নিতে পারেননি সুচিকিৎসা। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি হাফেজ রফিকুল। মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে একবেলা দুমুঠো খেলেও অন্য বেলা কাটে অনাহারে।
জুলুমবাজ বিগত আওয়ামী সরকার ও তাদের দোসরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ জুলাই বিপ্লব ও ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে আহত ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে বর্তমান সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলের কাছে জোর আকুতি জানিয়েছেন তিনি।
হাফেজ রফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে কারো কাছে মুখ খুলতে পারেননি তিনি। পা হারানোর পর যেটুকু চিকিৎসা চলে, তা অতিগোপনে। আমার দেশ-এর কাছে এমন বীভৎস দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন হাফেজ রফিকুল ইসলাম।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডু গ্রামের খোয়াজউদ্দীনের ছেলে হাফেজ রফিকুল ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের ডাকে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় যান তিনি। সেদিন সংগঠনটির ১৩ দফা দাবিতে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মী ও কওমি
মাদরাসার ছাত্রসহ কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে।
হাফেজ রফিকুল ইসলাম বলেন, ৫ মে রোববার বিকাল ৪টার দিকে তিনিসহ এলাকার বেশ কয়েকজন সাথী শাপলা চত্বরে পৌঁছান। তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য চলছিল। তিনি বলেন, এশার নামাজের পর শরিয়তের আলোকে বয়ান শুরু হয়। হঠাৎ রাত ১১টার দিকে শাপলা চত্বরসহ আশপাশের এলাকার বিদ্যুৎ চলে যায়। এলাকাটি ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তার কিছুক্ষণ পর নেতারা তাদের কাছে থাকা মোবাইল এবং ছোট চার্জার লাইটের মাধ্যমে খুবই স্বল্প আলোয় আবারও বয়ান শুরু করেন। রাত ২টার দিকে কেউ বয়ান শুনছিলেন, কেউ ঘুমাচ্ছিলেন আবার কেউ কেউ তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করছিলেন। ঠিক তখনই শাপলা চত্বরের তিন দিক থেকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সাধারণ পোশাকে হেলমেট বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে ফেলে গুলি, টিয়ারগ্যাস ও সাউণ্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে।
এ সময় কমলাপুরের দিকে যাওয়ার গলি রাস্তাটি ফাঁকা পেয়ে আমাদের সাথীরা ওই দিক দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। হাজার হাজার মানুষ ছোট গলিপথ দিয়ে তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে পদদলিত হয়ে অনেকে আহত হন।
চোখের সামনে গুলি ও টিয়ারশেলের আঘাতে অনেক সাথীকে মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে জীবন বাঁচাতে ওই সরু গলি ধরে বের হতে গিয়ে আমিও পড়ে যাই। পদদলিত হয়ে চরম আহত হই। ওই সময় সাথীরা আমাকে টেনে তোলেন। আহতাবস্থায় পাশেই একটি চৌকি ওয়ালের সঙ্গে কাত করা দেখে তার পেছনে লুকাই।
তিনি বলেন, সেখানে আগে থেকেই ১২-১৪ বছর বয়টি দুটি বাচ্চা ছেলে লুকিয়েছিল। মোবাইলের আলোয় দেখলাম তারা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমি তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকার পর পুলিশ ও হেলমেট বাহিনীর সদস্যরা এসে আমাদের ওখান থেকে বের করে। ওই সময় বাচ্চা ছেলে দুটি তাদের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করে জীবন ভিক্ষা চায়, আমিও চাই। এর মধ্যে ওই দুই ছেলেসহ আমাকে দৌড় দিতে বলে তারা। আমরা দৌড় দিতে গেলে হেলমেট বাহিনীর একজন আমার পায়ে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। ওখানেই আমি লুটিয়ে পড়ি। রাত ৪টার দিকে পুলিশ তাদের হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দেয়—পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হলো, কেউ যদি আশপাশে লুকিয়ে থাকো তাহলে এ সময়ের মধ্যে স্থান ত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় মরতে হবে। ওই ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন গলিতে লুকিয়ে থাকা সাথীরা হাত উঁচু করে বেরিয়ে এসে নিরাপদ দূরত্বে যেতে থাকেন।
তিনি আরো বলেন, ওই সময় আমার নড়াচড়া দেখে কয়েকজন সাথী সেখান থেকে আমাকে তুলে নিয়ে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে সেখানেও পুলিশ খোঁজ নিতে থাকে হেফাজতে ইসলামের কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে কি না। সেখানে ২৪ ঘণ্টা রেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে রেফার করে পঙ্গু হাসপাতালে। পঙ্গু হাসপাতালেও দফায় দফায় পুলিশ এসে ঝামেলা করত। পুলিশের কাছে তথ্য গোপন রেখে এক মাস সাতদিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরি। বাড়িতে পুলিশের ঝামেলা ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের চোখ এড়াতে কাউকে না জানিয়ে ছোট একটি ঘরের মধ্যে কাটাতে হয়েছে মাসের পর মাস।
এদিকে কোনো কাজকর্ম করতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কত বেলা যে অভুক্ত থেকেছি, তা বলে শেষ করার মতো নয়।
হাফেজ রফিকুল আরো বলেন, বর্তমানে নানাবাড়িতে ঘর তুলে বসবাস করছি। আমার নিজের কোনো সহায়-সম্পদ নেই। আগে পাশের গ্রামের একটি মসজিদে ইমামতি করতাম, পাশাপাশি জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতাম। এতে সংসারে সচ্ছলতা খুব একটা না থাকলেও কোনোমতে চলে যেত। এখন তো তেমন কিছুই করতে পারি না। এরপরও হেফাজতে ইসলামের সহায়তায় চিকিৎসা নিয়ে দুই বছরের মাথায় সামান্য হাঁটাচলা করতে পারলেও পরে পাঁয়ে পচন ধরে। সে সময় চিকিৎসা জন্য ভারতে যাওয়ার উদ্যোগ নেই। পাসপোর্ট করতে দিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আটকে দেয়। ফোনে পুলিশ পরিচয়ে পাসপোর্ট পেতে হলে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। পরে বহু অনুনয়-বিনয় করে অতিরিক্ত ছয় হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট আনার সুযোগ পাই।
পাসপোর্ট করা হলেও ভিসার জন্য তাকে আবেদন করতে দেয়নি আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। পরে বুঝতে পারেন এসব ওই সন্ত্রাসীদের কারসাজি, যে কারণে চিকিৎসার জন্য তিনি ভারতে যেতে পারেননি।
হাফেজ রফিকুল ইসলাম বলেন, পরে পচন ধরা পায়ের জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হেফাজতে ইসলামের আর্থিক সহায়তায় চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে পা কেটে ফেলেন। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলাফেরা করছেন। পাশাপাশি আগের বর্গা নেওয়া জমিতে নিজেই শ্রম দেন।
তিনি বলেন, কৃত্রিম পা নিয়ে কাজ করতে ভীষণ কষ্ট হয়। তারপরও যতটুকু পারি নিজে করি, বাকি কাজ দিনমজুর দিয়ে করাতে হয়। এখন তো আর ইমামতি নেই, যে কারণে বহু কষ্টে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। তিনি জুলুমবাজ বিগত আওয়ামী সরকার ও তাদের দোসরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ জুলাই বিপ্লব ও ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে আহত ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বর্তমান সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলের কাছে আমার দেশ-এর মাধ্যমে আকুতি জানান।